হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

কথিত আছে যে, দ্রাবিড় জাতি সিন্ধু নদীর তীরে বসবাস স্থাপন করে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ গড়ে তোলে। পরবর্তীতে এই দ্রাবিড় জাতিই আর্য ও অনার্য নামে হিন্দু পরিচিতি লাভ করে যারা একই ধরনের ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী যদিও স্থানও কাল ভেদে তাদের অবতার ও ধর্মিয় প্রথার প্রাধাণ্যের বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। তাই হিন্দু ধর্মকে নানা প্রথা ও বিশ্বাসের সমষ্টিও বলা হয়।

হিন্দু আইন কি ও কাদের উপর প্রযোজ্য?

হিন্দু আইন হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ও জীবন-যাপন প্রণালীকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন কতিপয় বিধিবিধান, প্রথা ও আচরণবিধির সমাহার। এ আইন যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত, হিন্দু পিতা মাতার অবৈধ সন্তান এবং যে ক্ষেত্রে পিতা খ্রিষ্টান এবং মাতা হিন্দু সেই ক্ষেত্রে অবৈধ সন্তান যদি মায়ের কাছে হিন্দু আচার অনুযায়ী লালিত পালিত হয়, তবে এসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হিন্দু আইনের উদ্ভবের সময়কাল সঠিকভাবে নিরূপণ করা দুষ্কর। এরূপ মনে করা হয় যে, এ আইন কারও সৃষ্ট নয় এবং অন্যান্য আইনের মতো এ আইন একদিনে প্রণীত বা ঘোষিতও হয় নি। বিধিবদ্ধ হবার পূর্বে এ আইন সম্ভবত প্রথা ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু সমাজের এসব বিধানের অধিকাংশই সংবিধিবদ্ধ হয়নি তাছাড়া হিন্দু আইন অনেকাংশেই প্রথার উপর নির্ভর করে আর একেক যায়গার প্রথা একেক রকম হওয়ায় এটিকে সহজে সংবিধিবদ্ধ করাও কঠিন । ফলে জমি-জমা ও সম্পত্তির বিচারকার্য পরিচালনায় নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্বতন কোন আদালতের রায়কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। সম্প্রতি ভারতে এসব ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর হিন্দু আইনে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে।

বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে হিন্দুদের মধ্যে দু’ধরনের উত্তরাধিকার পদ্ধতি চালু রয়েছে। যথা; দায়ভাগ পদ্ধতি এবং মিতাক্ষরা পদ্ধতি।

দায়ভাগ পদ্ধতি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে প্রচলিত আছে। এবং মিতাক্ষরা পদ্ধতি প্রচলিত আছে ভারতের অবাঙ্গালী সমাজে। আমাদের দেশের হিন্দুগণ দায়ভাগ আইনে পরিচালিত। দায়ভাগ মতে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানের অধিকারী ব্যক্তি মাত্রই মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী। (মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের যে অনুষ্ঠান তাকে ‘পিণ্ডদান’ বলে। )

দায়ভাগ আইনে তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকার নির্ধারিত আছে, যথা: সপিণ্ড, সাকুল্য এবং সমানোদক।

সপিণ্ড:

দায়ভাগ মতে সপিণ্ড হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর উত্তরাধিকার, অর্থাৎ, সবচেতে নিকটবর্তী উত্তরাধিকার। যাকে পিণ্ড দেয়া যায়, এবং যিনি পিণ্ডদান করেন প্রত্যেকের পরস্পরের সপিণ্ড। দায়ভাগ মতে সপিণ্ডের সংখ্যা ৪৮ জন, তবে সাধারণত ২০ জনের উপরে কারো উত্তরাধীকারীত্ব কার্যকর হয়না। এদের মধ্যে মহিলা সপিণ্ড ৫ জন, যথা: বিধবা স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা, পিতার পিতার মাতা। এই ৫ জন সম্পত্তিতে জীবন সত্ত্বের মালিক হয়।

জীবন সত্ত্ব:

জীবন সত্ত্ব বলতে বোঝায় যত দিন জীবন আছে তার ভাগের অংশটুকুর সত্ত্ব (title) বা অধিকার বা ভোগদখলের ক্ষমতা তার হাতে থাকবে কিন্তু তিনি এমন কিছু করতে পারবেন না যাতে এই সম্পত্তি শেষ হয়ে যায় বা নি:শেষ হয়ে যায় অর্থাৎ এরা ভোগাধিকারের অধিকারী, কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না, যেমন বিক্রয় করা, দান করা ইত্যাদি। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত পরিমাণে বিধি অনুসারে হস্তান্তর করতে পারেন, যেমন: মৃত ব্যক্তির দাহ কাজ সম্পন্ন করার জন্য, শ্রাদ্ধের খরচ যোগানের জন্য, সংসারের ব্যয় বা নাবালক সন্তানের লেখাপড়ার জন্য ইত্যাদি। তাদের জীবন শেষে এই সম্পত্তি ঐ জীবন সত্ত্বের অধিকারীর উত্তরাধিকারীদের কাছে যায় না বরং তা তিনি যার কাছ থেকে পেয়েছেন তার অন্য উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত যায়, সহজে বলা যায় যার কাছ থেকে এসেছে তার কাছে ফেরত যায় এবং আবার ভাগ হয়ে তার উত্তরাধিকারদের কাছে যায়। এই জীবন সত্ত্বের কারণে স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতার মাতা, পিতার পিতার মাতা উত্তরাধিকার হিসেবে তাদের পূর্ণ ক্ষমতা (বাপ- ভাইদের মত) প্রয়োগ করতে পারে না এবং তাই বাংলাদেশে এই কথা প্রচলিত আছে যে, হিন্দু আইনে মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পায় না। তবে মেয়েরা নিজেরা বিভিন্ন ভাবে সম্পত্তি অর্জন করতে পারে ও পেতে পারে যাকে স্ত্রীধন বলে যা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল।

স্ত্রীধন:

স্ত্রীধন বলতে নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বোঝায়। নারীরা এ সম্পদ উপহার হিসেবে পেতে পারে বা নিজে অর্জন করতে পারে এর উপর একজন হিন্দু নারীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে এই অর্থ এবং সম্পদ সে তার মত করে ব্যবহার করতে পারবে এবং তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার মৃত্যুর পর বণ্টন হবে। এক কথায় বলা যায় স্ত্রীধনের এর উপর নারীর চূড়ান্ত অধিকার ও কর্তৃত্ব রয়েছে।

এই স্ত্রীধনের কারণে এবং সমাজের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আসলে হিন্দু সমাজে যৌতুক প্রথার প্রচলন চলে আসছে। কারণ বাস্তবতায় সাধারণত বোন বা নারীরা জীবন সত্ত্ব নিয়ে তা রক্ষণাবেক্ষণ ও ভোগ করতে পারেনা এবং তাদের মৃত্যুর পারে তা আবার ফেরত যায় তাই সেই নারীর স্বামী বা সন্তানরা কিছু পায় না। আবার এইসব কারণ হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাশ না হওয়ার একটি কারণ ও বটে।

সাকুল্য:

সাকুল্য দ্বিতীয় শ্রেণির দূরবর্তী উত্তরাধিকার। এক কথায়, পিতামহের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষের উত্তরাধিকারগণ সাকুল্য নামে অভিহিত। দায়ভাগ মতে সাকুল্য উত্তরাধিকারীর সংখ্যা ৩৩ জন।

সমানোদকঃ সমানোদক অনেক দূরবর্তী ৩য় শ্রেণীর উত্তরাধিকার। সমানোদক বলতে ঊর্ধ্বতন ৭ পুরুষের উত্তরাধিকারদের বোঝায়, যারা মৃতের শ্রাদ্ধের সময় পিন্ডজল প্রদান করে। এখানে মহিলাদের স্থান নেই, এদের সংখ্যা ১৪৭ জন।

দায়ভাগ উত্তরাধিকারের কিছু সাধারণ নিয়ম:

  • ১। দায়ভাগ আইনে পিতার মৃত্যুর পর পুত্রগণ পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভ করে।
  • ২। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রগণ যৌথ পরিবার গঠন করতে পারে। যৌথ পরিবারের কর্তা প্রয়োজনে সম্পত্তির কিছু অংশ ক্রয়, বিক্রয় , বন্ধক বা অন্যভাবে হস্তান্তর করতে পারেন।
  • ৩। কোন হিন্দু মালিক যখন মারা যান, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে উত্তরাধিকার শুরু হয়। ভবিষ্যতে কোন উত্তরাধিকারী জন্মগ্রহণ করতে পারে বলে উত্তরাধিকার স্থগিত রাখা যাবেনা।
  • ৪। স্ত্রীধন বলতে নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বোঝায়। এর উপর নারীর চূড়ান্ত অধিকার ও কর্তৃত্ব রয়েছে।
  • ৫। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও পুত্র থাকলে স্ত্রী পুত্রের ১ অংশের সমান অংশ পাবে।
  • ৬। একাধিক কন্যা থাকলে কুমারী কন্যা পাবে, বিবাহিত নিঃসন্তান কন্যা পাবেনা। কন্যার গর্ভজাত পুত্রসন্তান উত্তরাধিকারী হবে।
  • ৭। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী জীবন সত্ত্ব ভোগ করেন। তার মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে ভাগ হয়।
  • ৮। বণ্টনের সময় কোন অংশীদার মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীগণ ওয়ারিশ হবে।
  • ৯। কোন পুত্র দত্তক নিলে সে স্বাভাবিক পুত্রের ১/৩ অংশের মালিক হয়।
  • ১০। কন্যার পুত্র অর্থাৎ দৌহিত্ররা মাথাপিছু হারে সম্পত্তি পাবে।

কখন উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন:

হিন্দু আইনে কিছু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারী এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, যথা:

  • ধর্মচ্যুত হলে বা ধর্ম ত্যাগ করলে
  • সন্ন্যাসী উত্তরাধিকার হয় না। সন্ন্যাসীকে সংসার ত্যাগী হিসাবে মৃত ধরা হয়।
  • অন্ধ, বধির, মূক, অঙ্গহীন, পুরুষত্বহীন এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পুরুষ ও মহিলাগণ হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত। এমনকি দুরারোগ্য কুষ্ঠ-ব্যধীগ্রস্ত ব্যক্তিগণও উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত।
  • স্বামী অসতী স্ত্রী রেখে মারা গেলে, সেই অসতী স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি পাবে না।
  • হত্যাকারী এবং তার ওয়ারিশ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে।

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন আরো বিস্তারিত এবং অংক ও ছবি  সহ জানতে ও বুঝতে আমাদের ইংরেজী লেখাটি দেখুন এখানে


সর্বশেষ হালনাগাদঃ জুলাই ২২, ২০২২